Rezanur Rahman Reza


Selected Poems of Hassanal Abdullah হাসানআল আব্দুল্লাহ'র নির্বাচিত কবিতা

Collected Poems by Baitullah Quaderee বায়তুল্লাহ্ কাদেরী'র কাব্যসমগ্র





Back to Issue 47_48
Back to Front Page
Shabdaguchha: Logo
Issue 47/48 : January - June 2010 : Volume 12 No 3/4



    রেজানুর রহমান রেজা

    বায়তুল্লাহ্ কাদেরী’র কাব্যসমগ্র: জ্ঞানদীপ্ত বিভোর উচ্চারণ

    মাটির ঘ্রাণ আসে বায়তুল্লাহ্ কাদেরী’র কাব্য থেকে। সৃষ্টিশীলতার অমিত সম্ভাবনার সোঁদা গন্ধে তরতর বেড়ে ওঠে সুমিষ্ট ঘ্রাণময় চারাগাছ। ঋতু এসে উঁকি দেয় কখনও। ‘শীত’ হয়ে ওঠে সক্রেটিস, বাল্মীকি,— ‘গায়বী শিক্ষক।’ শীতের সপক্ষে স্বপ্ন গড়েন কবি। কেননা: ‘শীত নিরুদ্বেগ/তেমনই মহর্ষিবৎ, শান্ত সৌম্য কান্তিমান মুখে/বলে জীবনের কথা’(শীতাভ সনেটগুচ্ছ)।
    ‘নমস্য শীত’-এর পর ‘বিরহিণী বর্ষা কাঁদে/ জলমগ্ন স্বরে।’ এই ‘দৌরাত্বপ্রিয় বর্ষা’ যেনো ‘আমাদের প্রিয় অবতার।’ এই বর্ষা কবি’র সত্তায় আচ্ছন্ন যেনো। কখনও এ তাঁর ‘ঠাণ্ডা, নির্জন গৃহিণী’ কেবল কাঁদে ‘বুকের মধ্যে’:

    ...আমি এই প্রিয় বর্ষাকে কেবল
    আত্মায় জমিয়ে রাখি, পিঞ্জরের সুবর্ণ শেকল
    ভেঙে জল ওঠে, চতুর্দিকে দুষ্টু পানির আহব
       (বর্ষা: সাত)

    প্রার্থনা:
    ...বৃষ্টিসৈন্য সজ্জিত করুণ
    মা-জি, রাজ্যময়; ছুঁড়ে দিন তীক্ষè শর, এ অস্থির
    পদতলে ধরুন অস্থিরতা,...

    ...
    ভিজুক এ বঙ্গদেশ, হোক মৃত্তিকা যৌবনবতী
       (বর্ষা: দশ)

    কারণ:

    আমিও বর্ষার পুত্র,...
    ...বর্ষাহীন অতিরুক্ষ খরাময়
    এইদেশে আমি আজ অতিক্রান্ত লোহিত সময়।
       (বর্ষা: চৌদ্দ)

    মানুষ পাখির মতো অতি ক্ষুদ্র হবে যে তখন-এ আলাওলকে মনে পড়ে। ‘কালজ’ কথনই শুধু নয়, কালোত্তীর্ণ শব্দের সমাহারে ‘মেঘের কুঞ্চিত কল্লা’র সাথে উঁকি দিয়েছে ইতিহাস, মীথ, সৌর-সদৃশ পুরুষ চণ্ডীদাস, লালন। ‘অচিন পাখির ভাষা’য় বলেন:

    তোমারে কহন্ত কত ওহে নাগেশ্বর
    যেওনা কো গয়ানের গাছে ফল-লোভে
    শব্দপ্রিয় শহরের মতো হৃদয়ের সঙ্গে
    করিলুং বাঁধাবাঁধি,
    এখন নতুন আর কীবা কহিবাম,...
       (তোমারে কহন্ত কত, পৃষ্ঠা ৩৮)

    তবুও বায়তুল্লাহ্’র কবিতার ‘শরীল’ গড়ে উঠেছে নতুন, বয়সী ও অভিজাত শব্দের মিশেলে। নতুন করে জড়তাহীন ভাবে বলেছেন। লোকজ জীবনের টুকিটাকি পৌরাণিক আদলে অকপট বিচরণ করেছে:

    বেহেস্ত জুড়ে রাধা-কানাই
    দুলতে দেখি, ধুলোয় ওড়ে
    লালন একা মরমিয়া
       (তিনি দোজখ, পৃষ্ঠা ৪১)

    ‘মাছ্যা রাঙা’ ‘আশিনবেলার লতা’ ‘নবির দেশে কাঁটা দেওয়া বুড়ি’ ‘গোবরনিকনো উঠোন’ নতুন মিশ্রণ বৈকি। ‘বর্ষা নামে ভাদ্রের কৈয়ের মতো’, ‘চিলের স্বভাব পেয়েছে বাতাস’ ‘বদনার জলে ধুয়ে নিয়ে যায়/গ্রামের উঠোন’, ‘শস্যের সাথে আমরা পেলাম নারীকেও/যাকে রাত জেগে নিবিড়ে বপন করে যেতে হয়’, ‘আমার গ্রীষ্মের মাঝে নিদারুণ শীত,/অচীন কুমার এসে ঢেলে দেবে ঝড়/নড়বে হৃদয়’— কবিতায় উজ্জ্বল নতুনতা। তবুও তাঁর আতœানুসন্ধান:

    আমিও আমার কাছে ফিরে যাই,
    মনহীন মনে পড়ে থাকে মন;
    কোথায় যে ফেলে যাই মন চশমার
    খাপের মতন টেবিলে,...
       (গাড়ি, রেলগাড়ি সন্ধ্যা, পৃষ্ঠা ৪১)

    ত্রিণাচিকেতের নাচ নূপুরের মতো ললিত আনন্দময়তায় ঝংকৃত। কমলার ‘ছায়াবতী কোমরের ভঙ্গি’তে নেচে ওঠে চাঁদও:

    চন্দ্রকলা নৃত্যে যেন ভরে দেবে উঠোন ছায়ায়
    যেন বা রাহুর গ্রাসে চাঁদ কাবু হলো অসহায়
    উদ্বাহু কমলা-ধুম সুললিত শরীরী-ধুয়ায়
    কমলা বেঁকেছে খুব স্বপ্নময়ী নৃত্যের বিভায়

    স্থূলকায় এই কাব্যের পংক্তিমালায় মানুষ-পাখিরাও নৃত্যময়:

    পাখির রোমের নীচের সর্বনাশ
    চোখে পড়ে যায়, বেভুলো পাখির
    প্রয়াত রতির
    চিৎকার আমি ভুলি অনায়াসে, শুধু অবসিত মনে হতে থাকে চিরদিন তাকে
    আসলে মানুষ একটি পাখির শুভ্র কফিন

    ...
    পাখির নাচে
    ছিন্নভিন্ন হয় বৈকালিক রোদ, হ্রদ খালি করে উড়ে যায় পাখির ফোয়ারা

    ...
    মানুষ তো পাখি, গান গাবে
    উড়ে যাবে,
    ডানা সাঁতরাবে,

    অনন্ত সংসারে
    পাখির ঝাঁকের সঙ্গে বুঝি চিনে নিবে গুলির র্ছরারে...
       (পাখি-২, পৃষ্ঠা ৬৭)
    নৃত্যময়তার মধ্যেও কবি যেনো:

    জল-তরঙ্গের সঙ্গে ভেসে আসা কথার ঝিলিক
    যেনবা ভাসন্ত হাঁস
    শুভ্র, দোলা-লাগা, এই পথ
    শেষ নয়,
       (খনা, পৃষ্ঠ ৮৯)

    অরণ্যের মত নিবিড় পুরুষ এই আত্মা আমি
    জ্ঞানত কালজ্ঞ হৃদপদ্মস্থিত চন্দ্রর
    দোদুল্যমান স্বজন
       (উট-মেঘ, পৃষ্ঠা ৯১)

    সনেটের পায়ে হাঁটা’য় বাঘ বিষয়ক সনেট চমকপ্রদ। মানবীয় চরিত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ‘স্তব্ধ ভবঘুরে বাঘ।’ এই ‘আনলাকি মামা’ ‘শেয়ালের তুখোড় চালাকি/বুঝতে না পেরে বেছে নেয় খাঁচাবাস।’ তবু আমরা ‘দেখি বাঘ নাই—আছে ভয়।’ ‘সনেটের বউ’, ‘সিনীবালি’, ‘পাখি-৩’, ‘সাত’, ‘মানবনদী’, ‘মৃত্যু কবিতাগুলো গভীর’, গহীন এক অনাবিষ্কৃত বোধে টেনে নেয় বার বার। ‘সাত’-এ ইউসুফের স্বপ্নের ব্যাখ্যা আছে গুরুর গম্ভীরতায়। ‘মানবনদী’র অষ্টক আটবার পড়েও মনে হয় নতুন। মৃত্যুতেও গতিমান কাদেরী। তাঁকে ‘পেরুতে হয় আলোকবর্ষের ঘর্মময়/একটানা পথ।’

    কিম্ভূতহবার কথা ছিল’য় আগুনকে ভালবেসে ‘লোডশেডিং-কাল’ পেরিয়ে পৌঁছে যান এক ‘হাঁটু- মোড়া সকাল’-এ। ‘তার শোণিত ও হৃদয়ের ভাবাবেগ/সংক্রমিত হয় তৃতীয় সকালে।’ কষ্ট হয় খুব ওহাব স্যারের জন্য যিনি ‘কথা বলতেন যেন মেঘের ভিতরে মেঘ ভেসে এসে/কবিতা ঝরিয়ে যেত, হাসতেন যেন ব্রহ্ম ডেকে উঠতেন নিনাদিত।’ তাঁর ‘সম্রাট কবি’র প্রতি এ এক হৃদয়-উৎসারিত জলধারাময় প্রণতি।

    শব্দের কারুকার্যের সাথে তাঁর প্রেমাগ্নিময় মনন বলতে চায়:

    স্নানে তুমি মারাত্মক উষ্ণ, নগ্ন-ত্বক
    বাথটাবে সীমিত জলের ক্রীড়ামগ্ন
    হংসীর উন্মুক্ত গ্রীবা, বলতেই চাই—
    টাওয়েলে শরীর মুছে ছাঁচা-ভাস্কর্যে—
    নিখাদ-নিকষ-নির্মেদ নক্ষত্ররূপে
    দাঁড়াতেই ভালবাস; এবং মানায়
    এই ভঙ্গি আজীবন তোমাকে,...
       (বিষপায়ী নিঃসঙ্গ হীরক, পৃষ্ঠা ১৩৭)

    প্রজন্ম লোহিত এক লোহিত অধ্যায় যাতে প্রজন্মের পরিণত কালের পৃথিবী, জীবন ও যান্ত্রিকতার ছাড়া ছাড়া রক্তিম পথ মৃত্যুময়:

    কত শতাব্দীর সুবিধাকে ফেলে দিয়ে
    গ্রহণ করেছো লাল অসুবিধা।
    থরে থরে
    কবর বিছানো পথ।

    ‘আবর্জনা, বস্তিময়’ পৃথিবীর ‘আস্তরণে’ ‘ব্যতিক্রমী ফুল’ ফোটে না। শুধু ‘অরুচির মতো ফুটে আছে মানবতা।’ ‘নিছক দ্রব্যের ভারে/ন্যুব্জ’ পৃথিবীর নৌকোও মাঝিহীন:

    এমন ছিপছিপে নৌকো
    এমন উজাড় করে ভাসে, একাকী ভাসার
    আনন্দেই মেতে থাকা নৌকো

    বাতাস পালের দুধে হাত রাখে, স্পর্শ শিহরণময়,
    ধাবমান স্রোত খলখলিয়ে ওঠে।

    ‘গন্ধমের পাপে’ আমাদের এই দেশ হয়েছে লাল গ্রহের মতো। এখানে ‘ঝিরিঝিরি বাতাসের মধ্যে বিকেলবেলার/রুগ্ন ধুলো অক্সিজেনহীন।’ ‘পুড়ে পুড়ে লাল হয়ে গেছে যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ/হতাশায় ক্লান্তিতে অভিমানে।’ আহ্বান:

        যেখানেই যাও
    মানব, পৃথিবী করে নিও তাকে, যেহেতু মানব ছিলে
    তেমনি মানব থেকো, নদীর মতনই ধোয়া-মোছা, পরিষ্কার।

    আড়ম্বর এর আবহ ধোঁয়াশা, আবছায়াময়। শীতের সকালে আগুন পোহানোর পল বা খড়কুটো জ্বলে ওঠার ধোঁয়ার মধ্যের আগুনের উঁকির মতো কিছু অগ্নিময় ‘অদ্ভূত উদ্ভাবনা চোখে’ পড়তে চায়। মনে হয়:

    এইভাবে কতকাল আছি
    প্রাণের স্তূপের নিচে চেলির চুল্লির অগ্নিশিখা
    আছি কতকাল...অঙ্গারে, ধূম্রের নিভা-ভানু কুণ্ডলীর
    চাপা পাঁচালিতে—
    একেকটি বিধ্বস্ত আড়ম্বরে বাড়ন্ত অবলীলা লেলিহান
    ছড়িয়ে পড়েছে বুঝি জন্মান্তরে...
       (নৃত্য-২, পৃষ্ঠা ২০৬)

    বিতিকিচ্ছিরি লাইফ যাচ্ছে’র জীবন অস্বাভাবিক, অকাম্য। ‘পাথরে পৃথক হওয়া জলধারা’র মতো নিঃসঙ্গ, ‘কান্নাময়।’ ‘জ্যোৎস্না/পুড়ছে নিঃসঙ্গ চন্দ্রটির মতো।’ এখানে:

    তরঙ্গ উঠছে বেয়ে, তরঙ্গ নামছে, আবার তরঙ্গ
    স্রোত যাচ্ছে, জল যাচ্ছে বিতিকিচ্ছিরি লাইফ যাচ্ছে
    এইতো লাইফ, যাকে জিরাফের মতো যেতে দেখা যায়
       (বিতিকিচ্ছিরি লাইফ যাচ্ছে, পৃষ্ঠা ২৩০)

    তবু কাউকে কি না ব’লে পারা যায় এইসব একান্ত কথা:

    পথিকেষু,
    বলছি দুঃখের কথা,
    বলছি রজনীঘোর একা
    লহুর জহুরীস্রোতে চলাফেরা, কী-প্রকার বৃষ্টিপাতে
    ভরেছে পৃথিবী
       (তুয়া অভিসারে রে মাধব, পৃষ্ঠা ২৪৭)

    বায়তুল্লাহ্ কাদেরী রোদে তাতানো বাউল, যিনি বলে যাচ্ছেন পৃথিবী ও পথিকের পরিচয়, পারিপার্শ্বিক। নিরন্তর গম্ভীরতায় গীত তাঁর দূর-দুর্লভ সুরে এক দীর্ণ ডাক আছে। ‘নিঃসঙ্গ কাঁকর’ বিছানো পথের চারপাশে আছে বদলে দেবার বা যাবার সমূহ ইঙ্গিত। সেগুলো বুঝে নেবার ভার পাঠকের সহৃদয়তার ওপর। নিবিড় গ্রামে সাপের মতো শুয়ে থাকা আঁকাবাঁকা পথে একান্তে হেঁটে আর জোছনা রাতে আকাশের ফিনফিনে মেঘগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে কবিতাকে দেখে নেয়ার ভার পাঠকের।



    বায়তুল্লাহ্ কাদেরী, কাব্যসমগ্র, লেখাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১০: পৃষ্ঠা ২৪৭, মূল্য ৩০০টাকা

Shabdaguchha, an International Bilingual Poetry Journal, edited by Hassanal Abdullah